বাংলাদেশের ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ঢাকায় "ক্র্যাক প্লাটুন" বাহিনী ছোট বড় মোট ৮২টি দুঃসাহসিক গেরিলা অভিযান পরিচালনা করেছিল। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল;- অপারেশন হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল,অপারেশন এলিফ্যান্ট রোড পাওয়ার স্টেশন,অপারেশন যাত্রাবাড়ী পাওয়ার স্টেশন,অপারেশন ফার্মগেট চেক পয়েন্ট, অ্যাটাক অন দ্য মুভ,ডেস্টিনেশন আননোন প্রভৃতি। এসব গেরিলা অপারেশনের মাধ্যমে ক্র্যাক প্লাটুন বাহিনী পাকিস্তানিসেনা এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের মধ্যে চরম আতংক ও ভীতির সঞ্চার করতে পেরেছিল। তারাই রচনা করেছিল মুক্তিযুদ্ধের নতুন আর এক ইতিহাস গেরিলা যুদ্ধ।
অসীম সাহসী বাহিনীর হামলাগুলোর মাধ্যমেই বিশ্ববাসীর দুয়ারে পৌঁছে যায়,এই দেশে একটি স্বাধিকার আন্দোলন তথা অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধ চলছে। বিশ্ববাসী আসল সত্যটা জেনে যায় এবং পাকিস্তানিরা চাপের মুখে পড়তে শুরু করে। একে একে বানচাল হতে থাকে পাকিস্তানি সরকারের কূট কৌশল। এরপর ক্র্যাক প্লাটুন বাহিনীর অতর্কিত হামলায় দিশেহারা হয়ে পাক আর্মি এদের ধরতে পুরো ঢাকা শহর চষে বেড়ায়। এমনকি তারা এদের ধরে দেওয়ার জন্য দুই হাজার টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করে। ১১ আগস্টের হামলার পর পাকিস্তানি বাহিনীর চিরুনি অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে এবং এদেশীয় কিছু কুখ্যাত রাজাকার,আলবদর দোসরদের সহযোগিতায় ধরা পড়ে যায় বিচ্ছু বাহিনীর সদস্যরা!
১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট। রেইড চালিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রায় ১৫ জন গেরিলা যোদ্ধাকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের ধরে টর্চার সেলে নিয়ে নির্মমভাবে অবর্ণনীয় অত্যাচার চালায়। নিষ্ঠুর টর্চারের মুখোমুখি হয়েও তারা একজনও মুখ খোলেননি এবং নতি স্বীকার করেননি শত্রুপক্ষের কাছে। পরবর্তী সময়ে এই সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে নয়জনের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি! আমাদের স্বাধীনতার আস্বাদ পাইয়ে দিতে গিয়ে,তারা অকাতরে জীবন উৎসর্গ করেছেন।
১৯৭১ সালের জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে ক্র্যাক প্লাটুন ছিল পাকিস্তান আর্মির কাছে অপ্রতিরোধ্য এক ত্রাসের নাম! যারা অতর্কিতে আক্রমণ করে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল শত্রুসেনাদের মনোবল। অনেক সাহসী তরুণ সদস্যদের নিয়েই গঠিত হয়েছিল ক্র্যাক প্লাটুন। তবে প্রাথমিকভাবে গঠিত দলের ১৭ জন সদস্য ঢাকায় অপারেশনের জন্য আসেন। ক্রমান্বয়ে ক্র্যাক প্লাটুন দলের সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। এই দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন;-শহীদ শফি ইমাম রুমী,শহীদ মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদ,শহীদ বদিউল আলম বদি,শহীদ আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল,শহীদ মোহাম্মদ আবু বকর,শহীদ আলতাফ মাহমুদ,আহমেদ মুনীর ভাষণ,আজম খান,নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু,লিনু বিল্লাহ এবং আরও অনেকেই।
একাত্তরের ৯ জুন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। অদম্য সাহসী ১৭ তরুণ। সম্বল মাত্র ১২টি গ্রেনেড,১৬০ রুপি (তখনকার পাকিস্তানি মুদ্রা) আর একটি করে বেয়নেট। ২১ বছর বয়সী হাবিবুল আলমের নেতৃত্বে এই দলটি জীবন-মৃত্যু তুচ্ছ করে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন বিশ্ববিবেক। শুধু দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সৈন্য ঘেরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সফল আক্রমণ চালিয়ে পৃথিবীকে জানিয়েছিলেন নিরস্ত্র বাঙালি হার মানতে জানে না। ওই দিন রচিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের নতুন একটি ইতিহাস-গেরিলা যুদ্ধ। দলটি গঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন খালেদ মোশাররফ বীরউত্তম। খালেদ মোশাররফের নির্দেশেই দুঃসাহসী এই তরুণরা অত্যন্ত ঝুঁকির সঙ্গে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গ্রেনেড হামলা করে বেশ কয়েকজনকে হত্যা করেন। সন্ধ্যায় বিবিসির খবর থেকে খালেদ মোশাররফ এই অপারেশনের কথা জানতে পেরে বলেন,‘দিজ অল আর ক্র্যাক পিপল।’ তিনিই প্রথম এই দলটিকে ক্র্যাক আখ্যা দেন; যা পরবর্তীতে "ক্র্যাক প্লাটুন" নামে পরিচিত হয়। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ‘হিট এন্ড রান’ পদ্ধতিতে অসংখ্য আক্রমণ পরিচালনা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মধ্যে ব্যাপক ত্রাসের সঞ্চার করেন।
পাঁচ-ছয় জনের এক একটি দল তৈরি করে এই গেরিলা দলটি অপারেশনে অংশ নিত। ঢাকা শহরে তারা মোট ৮২টি অপারেশন পরিচালনা করেন।পরিচালিত অভিযানগুলোর মধ্যে অপারেশন ফার্মগেট একটি;যার সময়কাল মাত্র এক মিনিটের মত,তবে বিস্তৃতি ব্যাপক। ফার্মগেট অপারেশন সংঘটিত হয় ৭ আগস্ট। প্লাটুনের অন্যতম সদস্য সামাদের নিউ ইস্কাটনের বাসায় সবাই বসে সিদ্ধান্ত নেন ওই দিনই আক্রমণ চালাবেন তারা। অপারেশনের সময় নির্ধারিত হলো রাত ৮টা এবং এর জন্য সময় বরাদ্দ থাকবে ১ মিনিট। অস্ত্রসজ্জিত গেরিলা দলে ছিলেন ৭ তরুণ। জুয়েল,আলম,পুলু, স্বপন,সামাদ আর বদি। ঠিক করা হয় সামাদ গাড়ি চালাবেন। সবার হাতে থাকবে স্টেনগান, আলমের হাতে চায়নিজ এলএমজি। অতিরিক্ত অস্ত্রের মধ্যে সামাদের কাছে আছে রিভলবার,জুয়েল আর পুলুর কাছে আছে ফসফরাস গ্রেনেড আর গ্রেনেড-৩৬। এক মিনিটের মধ্যেই খান সেনা আর পাকি পেয়ারা রাজাকারদের দিগি¦দিক অন্ধকার করে দেয় চৌকস গেরিলা দলটি। মুহুর্তেই মরণের স্বাদ পায় পাঁচ মিলিটারি পুলিশ ও ছয় রাজাকার। সফল এই অপারেশনের নেতৃত্বে ছিলেন শহীদ বদিউজ্জামান।
এই ঘটনা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে সারা ঢাকায়,আর নতুন উদ্যাম যোগ করে সারা দেশের মুক্তিকামী মানুষের মনে। আর ব্যাপক ভীতি সঞ্চার করে খান সেনা আর তাদের দোসর রাজাকারদের মধ্যে। এভাবেই অনেকগুলো সফল অপারেশন চালান এই ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যরা।
ক্র্যাক প্লাটুনের গর্বিত সদস্যরা হলেন: এই গেরিলা দলটিতে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম কয়েকজন হলেন- আবুল বারক আলভী,শহীদ আব্দুল হালিম চৌধুরী জুয়েল বীরবিক্রম,পপসম্রাট আযম খান,আমিনুল ইসলাম নসু,আলী আহমেদ জিয়াউদ্দিন বীরপ্রতীক,ইশতিয়াক আজিজ উলফাত,সাদেক হোসেন খোকা,কাজী কামালউদ্দিন বীরবিক্রম, কামরুল হক স্বপন বীরবিক্রম,গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীক,চুন্নু,জহির উদ্দিন জালাল, জহিরুল ইসলাম,নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, নীলু,পুলু,ফতেহ চৌধুরী,শহীদ বদিউজ্জামান, বদিউল আলম বদি বীরবিক্রম, মতিন ১,মতিন ২,শহীদ মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদ, মাহবুব,মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম,মাযহার,রাইসুল ইসলাম আসাদ,লিনু বিল্লাহ,শহীদ শাফি ইমাম রুমী,শহীদুল্লাহ খান বাদল,শাহাদত চৌধুরী,সামাদ,হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক,হিউবার্ট রোজারিও এবং হ্যারিস প্রমুখ।